রাতে সবাই একসাথে খেতে বসেছি। খেতে বসার পর পরই ভাইয়ার দিকে তাকিয়ে ছোট বোন তিশা ভাতের প্লেটটি উল্টে ফেলে দিলো। টেবিল থেকে উঠার সময় তিশা কঠিন গলায় বললো,
– যেই ঘরে আমার কথার কোন মূল্য নেই, সেই ঘরের ভাত আমি খাবোই না। যদি না খেয়ে মারা যেতে হয়, যাবো। তবু ও খাবো না!
হঠাৎ করে তিশার মুখে এমন কথা শুনে ঘরের সবাই বিস্মিত হয়ে গেলাম। মা খাবার রেখে বসা থেকে উঠে গিয়ে তিশাকে বললো,
– তুই এমন কাজটা কিভাবে করতে পারলি ? বেয়াদব দেখেছি, এমন চূড়ান্ত বেয়াদব দেখিনি!
তিশা জোরালো গলায় বললো,
– বেয়াদব হয়ে ভালোই হয়েছি। যে ঘরে আমার কথার মূল্য নেই, সে ঘরে ভালো হয়ে থাকার চেয়ে বেয়াদব থাকাই ভালো। ভাইয়াকে কতোদিন ধরে বলে আসছি আমার জন্য মোবাইল নিয়ে আসতে। অফিস থেকে ফেরার সময় সবকিছু আনতে মনে থাকে, শুধু আমার মোবাইলটি আনতেই মনে থাকে না।
মা গলার স্বর নিচু করে বললো,
– তিশা তুই জানিস একটা মোবাইলের কতো দাম ? সংসারের অবস্থা তো বুঝতেই পারছিস, এতো বড় হয়েছিস তবু ও সংসারের অবস্থাটা কেন বুঝার চেষ্টা করিস না ?
– এখন বড় হয়ে গেছি তাই না ? মোবাইল কিনে আনার কথা বললে তখন তো বলো, এতো কম বয়সে মোবাইল দিয়ে কি করবি ?
মা তিশাকে কিছু একটা বলতে চেয়েছিল, না শুনেই তিশা বারান্দায় চলে গেল। মা শাড়ির আঁচল দিয়ে কপালের ঘাম মুছল। প্লেটে নেওয়া ভাত না খেয়েই মা শোবার রুমে ঢুকে গেলো।
আমি আর ভাইয়া খাওয়ার টেবিলে বসে আছি। ভাইয়ার শার্টে তরকারির ঝোল লেগে আছে। তিশা প্লেট উল্টে ফেলায় তরকারির যে ঝোল টুকু লেগেছে ভাইয়া তা মুছলো না। মাথা নিচু করে ভাত খাওয়া শুরু করলো।
আমার ভাত মুখে দিতে ইচ্ছে করছে না। ভাইয়ার ভীষণ মন খারাপ দেখে উঠে ও যেতে পারছি না। আঙ্গুল দিয়ে যখন প্লেটের ভাত নেড়েচেড়ে যাচ্ছি তখনি বাবা ডাইনিং রুমে ঢুকল। বাবার হাতে গ্যাস্ট্রিকের ট্যাবলেট, এই ঔষধটি খাওয়ার কিছুক্ষণ পরে ভাত খেতে হয়। তাই বাবা আমাদের সাথে ভাত খেতে বসে নাই। বাবা ঔষধের পাতাটি হাতে নিয়ে এগিয়ে এসে ভাইয়ার দিকে তাকিয়ে বললো,
– আমার মেয়েটার কি হয়েছে ? মেয়েটা হঠাৎ করে এমন রেগে গেলো কেন ? কি বলেছিস তুই, শুনি কি বলেছিস ?
ভাইয়া বাবার কথার জবাব দিলো না। হাত ধুয়ে চেয়ার থেকে নিঃশব্দে উঠে গেলো।
•
ঘুম থেকে উঠার পর পুরো বাড়িটা একদম নিস্তব্ধ মনে হলো। সকাল নয়টা বেজে গেছে অথচ মা নাস্তা করার জন্য একবার ও ডাকতে আসে নি। অন্যদিন এই সময়ে নাস্তা খাওয়ার জন্য মা ডেকে ডেকে অস্থির করে ফেলে।
বাড়ির এই নিস্তব্ধতা দেখে বিছানা থেকে উঠে কিচেন রুমে গেলাম। গিয়ে দেখি মা একদমই চুপচাপ বসে আছে। আমাকে দেখে বিষণ্ণ গলায় বললো,
– তর ভাইয়া আজকে সকালে না খেয়েই অফিসে চলে গেছে। অন্যদিন একটু দেরি করে অফিসে যায়, আজকে এতো তারাতারি কেন চলে গেলো বুঝতে পারছি না। তুই বল, সন্তান যদি না খেয়ে চলে যায় তাহলে মায়ের মন কিভাবে ভালো থাকবে ? আচ্ছা তিশার কথায় ছেলেটা অভিমান করেনি তো, খুব অভিমান ?
মায়ের কথাগুলো শুনে ব্যথায় আমার হৃদয় চৌচির করে উঠলো। মাকে কি বলে শান্তনা দেবো বলার মতো ভাষা খুঁজে পেলাম না।
ডাইনিং রুমে গিয়ে দেখি প্লেটে রুটি আর ডিম ভাজা করে রেখেছে। খুব সকালে করে রেখেছে বলে সবকিছু ঠাণ্ডা হয়ে আছে।
•
দুপুরে গোসল শেষ করে বারান্দায় এসে দেখি তিশা কলেজ শেষ করে বাসায় আসছে। ঘরে ঢোকার পর পরই তিশাকে বারান্দায় ঢেকে এনে বললাম,
– তিশা তুই কি জানিস বাবার চাকুরি শেষ হয়েছে কতো বছর হয়েছে ?
হঠাৎ করে এমন প্রশ্ন করায় তিশা কিছুক্ষণ চুপ থেকে বললো,
– ঠিক মনে নাই। তবে পাঁচ হতে ছয় বছর হবে।
আমি করুণ গলায় বললাম,
– তুই জানিস বাবা চাকুরি থেকে অবসরে আসার পর পরই ভাইয়া চাকুরীতে ঢুকে গেছে। কারণ একটাই যেন টাকার জন্য পরিবারে যে শূন্যতা তৈরি হবে তা যেন কেউ টের না পাই। বাবার পরেই বড় ভাইয়াদের স্থান কেন জানিস ? পৃথিবীর সকল কষ্টগুলো হাসি খুশি ভাবে মেনে নিয়ে পরিবারকে সুখে রাখার জন্য সবচেয়ে বেশি সেক্রিফাইস শুধু বড় ভাইয়ারাই করতে পারে।
তিশা মাথা নিচু করে ফেললো। আমি শীতল গলায় বললাম,
– আজকে ছয় বছর হয়েছে ভাইয়া চাকুরি নিয়েছে। অথচ আজ পর্যন্ত ভাইয়া তার পুরোনো ফোনটি পাল্টায়নি। বাবার জন্য ঔষধ, আমাদের দু’জনের পড়া লেখার খরচ চালিয়ে সংসারটা কোন রকম টিকে আছে এটাই তো বেশি। ভাইয়ার সাথে যারা চাকুরি করে তারা সবাই ছুটি পেলেই ঘুরতে চলে যায়। ভাইয়া বন্ধের সেই সময়টা পরিবারের সাথে হাসি খুশিতে কাটিয়ে দেয়। এসব কেন করছে ? শুধু তো আমাদের কথা ভেবেই। একটা মোবাইলের জন্য গতকাল রাতে ভাইয়ার সাথে তুই যে কাজটি করেছিস অন্যায় করেছিস, খুব অন্যায়।
আমার কথা শোনার সাথে সাথেই তিশার চোখ বেয়ে ফোটা ফোটা পানি পড়ছে শুরু করেছে। চোখের পানি মুছতে মুছতে বললো,
– মনের ভেতরে জমে থাকা রাগটা এমনভাবে নিয়ন্ত্রণহীন হয়ে যাবে বুঝে উঠতে পারিনি। আমার ফোন চাই না, শুধু চাই ভাইয়া যেনো ক্ষমা করে দেয়।
– ভাইয়া এতোটাই অভিমান করে আছে, সকালে না খেয়েই বের হয়ে গেছে। এই অভিমান কিভাবে ভাঙ্গবে আমার জানা নেই, সত্যিই জানা নেই।
তিশা মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছে। আমাকে কিছু একটা বলতে যাবে ঠিক তখনি অফিস শেষ করে ভাইয়া বাড়িতে ঢুকলো।
ভাইয়াকে দেখে তিশা আমার সামনে থেকে দৌড়ে চলে গেলো। যাওয়ার কিছুক্ষণের মধ্যেই অবাক করে দিয়ে প্লেট দিয়ে ভাত আর তরকারি এনে বড় ভাইয়ার সামনে এসে দাঁড়ালো। প্লেটটি ভাইয়ার হাতে ধরিয়ে দিয়ে বললো,
– যদি আপনি এখনি ভাত খাওয়া শুরু না করেন, আমি কিছুই মুখে দেবো না। শুনেছি সকালে না খেয়েই চলে গেছেন, এখন কিন্তু এক মিনিট ও দেরি করতে পারবেন না। খাবার মুখে না নিলে কোথা ও যেতে দেবো না।
ভাইয়া হাসিমুখে বললো,
– বোকা মেয়ে, সকালে অফিসের একটা জরুরী মিটিং ছিল তাই খাওয়ার সময় পাই নি।
তিশা বিষণ্ণ গলায় বললো,
– জানি গতকাল রাতের ঘটনায় খুব অভিমান করেছেন। এমনটা হয়ে যাবে আমি সত্যিই বুঝতে পারি নি। আমার মোবাইল চাই না, খুব বড় একটি অপরাধ করে ফেলেছি। অপরাধী এই ছোট বোনটাকে ক্ষমা করে দিবেন তো ?
তিশার হাতে প্লেটটি দিয়ে ভাইয়া নিজের রুমে ছুটে গেলো। সাথে সাথে রুম থেকে একটি নতুন মোবাইল নিয়ে বের হলো। মোবাইলটি হাতে নিয়ে তিশার খুব কাছে এসে বললো,
– তোর জন্য গত সপ্তাহেই মোবাইল কিনে রেখেছি। দুই দিন পরেই তর জন্মদিন। ভেবেছি জন্মদিনের আনন্দের মুহূর্তে মোবাইলটি তরে উপহার দেবো, তাইতো এর আগে শুনাইনি।
তিশার চোখ বেয়ে আবারো পানি পরতে শুরু করেছে। তিশা এবার চোখের পানি বন্ধ করার কোন চেষ্টা করলো না। ভাইয়া এগিয়ে এসে চোখের পানি মুছে দিয়ে বললো,
– এই নে তোর উপহার। উপহারটি এখনি দিয়ে দিলাম। আমার কাছে এই মুহূর্তটা জন্মদিনের আনন্দের মুহূর্তের চেয়ে ও বেশি আনন্দের।
ভাইয়া নিজের হাত দিয়ে তিশার চোখের পানি মুছে দিচ্ছে, অথচ ভাইয়ার চোখ ভিজে উঠছে আনন্দ অশ্রুতে। এই অশ্রুতে বোনের প্রতি ভাইয়ের গভীর ভালবাসা মিশানো। আমি ভাইয়ার চোখের দিকে বেশিক্ষণ তাকিয়ে থাকতে পারলাম না। আমি জানি বেশিক্ষণ তাকিয়ে থাকলে নিজের চোখে জমতে থাকা অশ্রু আটকে রাখতে পারবো না।
ভাইয়ার ভালবাসা
লেখকঃ- #মতিউর_মিয়াজী
The post ভাইয়ার ভালবাসা appeared first on Real worlds || ভালবাসার-গল্প, কৌতুক, টিপস, বিনোদন, জীবনী.
from Real worlds || ভালবাসার-গল্প, কৌতুক, টিপস, বিনোদন, জীবনী
0 Comments
Give your valuable feedback !